কথায় কথায় ঠাকুরের প্রসঙ্গ আসতেই আমার বুদ্ধিমান সহকর্মীটি চোখে কৌতূকমিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো:-
“তোদের ঠাকুর যে স্বয়ং ঈশ্বর তার কোন প্রমান আছে ? যতো যতো অবতার বা ঈশ্বরপুরুষের কথা শুনেছি সবারই নানা অলৌকিক ক্ষমতার কথা আমরা জানি। ভগবান রামচন্দ্র সমুদ্রের উপর পাথর দিয়ে সেতু বানিয়েছেন, আকাশপথে উঠে রাবনের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এত বিশাল গোবর্ধন পর্বত আঙ্গুলের উপর উঠিয়ে ভক্তদের রক্ষা করেছেন, শিশুকালে ভয়ংকর বিশাল কালনাগিনীকে যমুনার জলের ভিতর কাবু করেছেন, কংসের মত মহাশক্তিশালী রাক্ষসকে বধ করেছেন, অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন দিয়েছেন,-কত কি! ভগবান যীশু অলৌকিক ভাবে কত কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করেছেন, ক্রুশবীদ্ধ হবার পরও তিনি বেঁচে উঠেছিলেন । এমন প্রত্যেক ঈশ্বর পুরুষই তাদের জীবনকালে নানা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে সাধারণ মানুষের কাছে বিস্ময় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছেন৷ তোমাদের ঠাকুর তো ভাই এমন কিছুই করেননি যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ তাঁকে ঈশ্বর বা ঠাকুর বলে মেনে নেবো?”
” কে বলল দিদি:- শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র কোন অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেননি? তুমি পূর্ব পূর্ব গুরুদের যেসকল অলৌকিক ক্ষমতার কথা জানো,- তার চেয়েও অনেক বেশী বিস্ময়কর ঘটনা তিনি সারাজীবন ঘটিয়েছেন। এখন তিনি পার্থিব দেহে নেই,- তারপরও সেই অলৌকিক ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। “
সহকর্মী অবাক হয়ে জানতে চাইল,-" কেমন অলৌকিক ঘটনা? শুনি একটু। আমি তো আজ অব্দি তোদের ঠাকুরের কোন অলৌকিক ঘটনা শুনিনি কোথাও!! "
” দিদি, – একটু ভেবে দেখ,- বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে উঠা নিপাট সাদাসিধা সাংসারিক এক ব্রাম্মন মানুষ, যিনি সারাজীবনে একটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করেননি ,যিনি বিশাল বিশাল জনসভায় ধর্মীয় বক্তৃতা দেননি, কোন তাত্ত্বিক আলোচনা-তর্ক করে নিজের পান্ডিত্য প্রমান করতে যাননি, নিজেকে ঈশ্বর বা ঠাকুর প্রমানের জন্য কোন গেরুয়া-লাল বা রঙ্গীন বেশভূষা ধারন করেননি, মানুষকে মোহিত করার জন্য কোন অদ্ভুত মিরাকেল সজ্ঞানে ঘটাননি, হাত তুলে কাউকে আশীর্বাদ পর্যন্ত কোনদিন করেননি, স্ত্রী-সন্তান-পরিবার নিয়ে পুরোদস্তুর সাংসারিক জীবনযাপন করেছেন যিনি,- তিনিই আজকে বিশ্বব্যাপী কয়েক কোটি মানুষের জীবনের অধীশ্বর। সকলের ঠাকুর। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা কি তোমার কাছে অলৌকিক বোধ হয় না?
মানুষকে সহজে আকর্ষিত করার জন্য যেখানে তথাকথিত বিভিন্ন ধর্মগুরুগন শিষ্যদের উদ্দেশ্যে স্বভাবতই বলে থাকেন,- " আমার জন্য কিছু করতে হবে না,- শুধু সংসারের মাঝে থেকে আমায় মাঝে মাঝে স্মরন করবে, দুটো ফুল তুলসীপাতা পেলেই আমি খুশী।" -সেখানে শ্রীশ্রীঠাকুর দীক্ষান্তে প্রতিদিন ইষ্টভৃতি নিবেদন বাধ্যতামূলক করে দিলেন। অর্থ হল সংসারবদ্ধ মানুষের সবথেকে প্রিয় বস্তু,- বিনাস্বার্থে মানুষ একটি টাকাও কাউকে দিতে একশোবার চিন্তা করে থাকে। অথচ সেই সংসারাবদ্ধ-অর্থপ্রিয় মানুষজনকেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন নিজের কষ্টার্জিত আয় থেকে কিছু পরিমান অর্থ প্রত্যেকদিন প্রত্যুষে, অপ্রত্যাশিতভাবে, বিনাস্বার্থে, ভক্তিভরে নিজের ইষ্টদেবতার ভরনপোষনের জন্য নিবেদন করার জন্যে। শুধু কি তাই? ত্রিশদিনের দিন অন্নজল গ্রহনের পূর্বে সেই ইষ্টভৃতির অর্ঘ্য নিজে গিয়ে যথাস্থানে জমা করতে হবে। আবার,- সেই অর্ঘ্য ইষ্টসকাশে গিয়ে পৌঁছল কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য নিজ দায়ীত্বে অর্ঘ্যপ্রস্বস্তি সংগ্রহ করতে হবে। যেদিন ইষ্টভৃতি প্রেরন করব সেদিন নাকি আবার দুইজনকে ভাতৃভোজ্য দিতে হবে। অথচ,- এই সবকিছু করতে হবে কোনরকম প্রত্যাশা না রেখে। আজকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কয়েক কোটি সৎসঙ্গী নিয়মিত এই আশ্চর্য বিধি ' ইষ্টভৃতি ' পালন করে চলেছে,- বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার আশা না করেই। ইষ্টভৃতি প্রেরন করে তারা আবার এক বিস্ময়কর আত্মতৃপ্তিতে ভূগে থাকে৷ কোন ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা না থাকলে কি এতো এতো মানুষকে ইষ্টভৃতিপরায়ন করে তোলা সম্ভব, - ভাই?
শুধুই কি ইষ্টভৃতি করেই শেষ? প্রতিদিন সকালে খালিপেটে থানকুনি পাতা-জল খেতে হবে। লক্ষ কোটি মানুষ তা পালন করে চলেছে প্রত্যহ।
বাঙ্গালী,- অথচ মাছভাত খাবেনা,- এমনটা হয় নাকি? মাছ না খেলে বাঙালীর জাত বজায় থাকেনা বলেই অনেকের ধারনা । অথচ সেই বাংগালী জাতির মাঝেই প্রথম তিনি স্পষ্ট ভাষায় দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করলেন,-" মাছ মাংস খাসনে আর/ পেঁয়াজ রসুন মাদক ছাড়।"
আর তাঁর এই কথায় আজকে শুধু বাংগালী নয়,-সারা দেশে তথা বিদেশে নানা জাতির,নানা বর্নের লক্ষ লক্ষ মানুষ মাছ-মাংস ছেড়ে আজন্ম নিরামিষাশী হয়ে গেছে। কত কত ধূমপায়ী চিরতরে ধূমপানের কু অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে, মদ্যপায়ী মদ্যপানের মৃত্যুপথ থেকে ফিরে এসেছে তার কোন লেখাজোকা নেই। একজন সাধারণ গ্রাম্য ব্রাহ্মণের কথায় এতো এতো মানুষের স্বভাবে-জীবনযাত্রায় এই অকল্পনীয় পরিবর্তন কি তোমার কাছে অলৌকিক মনে হয় না ?
যার দেহরক্ষার মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, বার্মা, জার্মান, আমেরিকা, দুবাই, কুয়েত ইত্যাদি নানা দেশে তাঁর হাজার হাজার কেন্দ্র-মন্দির গড়ে উঠেছে, - অথচ এক টাকাও সরকারি সাহায্য ছাড়া, কোনরকম বিদেশি ফান্ড ছাড়া,- সেই ঠাকুরকে তোমার অলৌকিক মনে হয় না?
একটা ও কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেই, সারাজীবনে একটা বইও পুরোপুরি পড়েননি,- অথচ বিশ্বের এমন কোন বিষয় নেই- মানুষের জীবনের এমন কোন দিক নেই, - যে বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক দিকনির্দেশ ও সমাধান দিয়ে যাননি। বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্প-অর্থনীতি- শিক্ষানীতি-গার্হস্থ্যজীবন- বিবাহনীতি-সুপ্রজনন-চিকিৎসা ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয়ে তিনি এমন বিস্তৃত ও সূক্ষভাবে বলে গেছেন, এত উচ্চমানের বানী-সাহিত্য দিয়েছেন,- যা একজন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ইংরেজিতে কোনদিন কথা বলেননি,- অথচ ইংরেজিতে অজস্র বানী দিয়েছেন যেগুলির সাহিত্যিক মান পৃথিবীর বড় বড় পন্ডিতদের অবাক করে দেয়। এই ব্যাপারগুলি কি অলৌকিক নয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর আজকে পার্থিব দেহে অবর্তমান। তা সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন শতশত হাজারে হাজারে লোক তাঁর চরনতলে আশ্রয় নিচ্ছে। দেওঘরে তার নশ্বর দেহ নেই,- তবুও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেওঘর ছুটে যায় তাঁকে অনুভব করার জন্য,-তাঁর ভালবাসার টানে। এটাই তো অলৌকিক!!
সারা পৃথিবীতে নেশার কবল থেকে যুবসম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য কত কত আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, শাস্তির বিধান হচ্ছে, প্রচার-সচেতনতা করা হচ্ছে, নীতি নির্ধারক ও সরকারের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে, - কিন্তু সব বিফল!! দিন দিন যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে নেশার মৃত্যুছায়া বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের সৎসঙ্গে ঠিক উল্টো!! কোন আইন নেই, বাধ্যবাধকতা নেই, সচেতনতামূলক প্রচার নেই, নেশাবিরোধী সাইনবোর্ড নেই,- অথচ লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতী সৎসঙ্গে এসে ঠাকুরের সাথে যুক্ত হচ্ছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, নানা পেশায়, নানা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছে, সকলের সাথে স্বাভাবিক মেলামেশা আনন্দ করছে,- কিন্তু মদ-বিড়ি-সিগারেট স্পর্শও করছে না। এটাই তো আমার কাছে অলৌকিক ব্যাপার।
এত এত লোক শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষিত। যারাই অন্ততঃ ইষ্টভৃতিটুকু নিয়মিত করে, একটু হলেও নামধ্যান করে,- তাদের প্রতিপ্রত্যেককে ধরে ধরে জিজ্ঞেস কর,-" আপনি ঠাকুরকে ধরে কি পেয়েছেন? কেমন আছেন দীক্ষা নিয়ে?" সেই প্রতিপ্রত্যেকটা লোক তাদের জীবনে ঠাকুরের দয়ার প্রত্যক্ষ অনুভূতির কথা শুনাবে। ঠাকুর যে সেই প্রতিপ্রত্যেকটি মানুষের জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত,- তা তুমি তাদের মূখ থেকেই জানতে পারবে৷
আরো অলৌকিকতা তোমার জানার প্রয়োজন??
শিশুরা যে বয়সে শিশুসুলভ চপলতা ও খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকার কথা,- সেই বয়সের লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিদিন সকাল বিকাল প্রার্থনা করছে, মা-বাবাকে প্রনাম করছে, সৎসঙ্গে এসে ঈশ্বরের গুনকীর্তন করছে, সদাচারে অভ্যস্ত হচ্ছে। যে যুবসম্প্রদায় তাদের বয়সোজনিত তামসিক আনন্দ-উল্লাসে ব্যস্ত থাকার কথা, যে যুবসম্প্রদায় সাধারণত ধর্মকর্ম থেকে দূরে থাকতেই অভ্যস্ত ছিল,- সেই লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী আজকে সৎসঙ্গের অগ্রভাগে থেকে বাঁচা-বাড়ার কথা প্রচার করছে, সাত্ত্বিক জীবনযাপন করছে, কীর্তনে মাতোয়ারা হচ্ছে। সমাজের এই ব্যাপক পরিবর্তন অলৌকিক নয় কি?
ডাঃ রাজেশ চৌধুরী
আগরতলা