ডঃ অজিতেশ পাল : মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে মানুষের। মানুষ বাঁচতে চায় সুস্থ দেহে বহু বছর। অথচ অনিয়ন্ত্রিত চলনায় চলে মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, যে কয়েকটি হাতে গোনা রোগে মানুষের মৃত্যু হয় তাদের মধ্যে হৃদরোগ ও ক্যান্সার অন্যতম। আমেরিকান জার্নাল অব কার্ডিয়োলোজিনর গবেষণাপত্র বলছে যে, ভারতবর্ষে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৬ সালে ভারতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে কুড়িজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা হৃদরোগের কারণ হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ, ধূম্রপান, মাদকদ্রব্য সেবন, রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের বাড় বাড়ন্ত মাত্রাতিরিক্ত দেহের ওজন বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও দৈহিক শ্রম্যের অভাবকেই দায়ী করেছেন।
হৃদরোগ এড়াতে ইন্ডিয়ান ও আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন যেসব নিয়ম নীতি মেনে চলার কথা বলেছে সেগুলি প্রায় একইরকম। যেমন- ধুমপান ও মাদকদ্রব্য বর্জন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা, শরীরের ওজন, রক্ত চাপ, কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, টেনশনমুক্ত জীবন যাপন করা। তাছাড়া হার্ট ভালো রাখতে লাল মাংস ও সম্পৃক্ত আটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা, ফাস্টফুড কম খাওয়ার পরামর্শ দেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা। এসব খাবারের বদলে সবুজ শাক সবজি, ফলমূল, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, বিভিন্ন ধরনের দানাদার খাদ্য খাওয়ার লক্ষে পুষ্টি বিজ্ঞানীরা। প্রায় একই ধরনের অভিমত ভারতবর্ষের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ও পদ্মভূষণ পুরষ্কার প্রাপ্ত ডাঃ দেবী শেট্টির, হৃদরোগ ও স্ট্রোক ছাড়া যে আরেকটি প্রাণঘাতী রোগ মানুষকে বিচলিত করে তার নাম ক্যান্সার। যদিও প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার নির্ণীত হলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীই সুস্থ হয়ে উঠেন।

২০১৬ সালের ক্যান্সার রোজাস্ট প্রোগ্রানের তথ্য অনুসারে ভারতে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার মানুষ ক্যান্সারে মারা যান। প্রতি আট মিনিটে একজন মহিলা সার্ভিক্যাল ক্যন্সারে মৃত্যু বরণ করেন। তবে আশার কথা হল যে, ভারতবর্ষের অধিকাংশ ক্যান্সারই প্রতিরোধ যোগ্য। দিল্লীর ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (AIIMS) এর রেডিয়েশন অনকোলোজি বিভাগের পাঁচজন চিকিৎসকের গবেষণালব্ধ ফল বলছে ভারতবর্ষে সত্তর শতাংশ ক্যান্সারই প্রতিরোধ যোগ্য অর্থাৎ কিছু নিয়মনীতি মেনে চললে এই মারণব্যাধিকে ঠেকানো অসম্ভব নয়। ক্যান্সার ঠেকাতে যেসব নিয়মনীতি ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণ মেনে চলতে বলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ধুমপান সহ যেকোনও মাদকদ্রব্য বর্জন, মদ্যপান এড়িয়ে চলা, অলস জীবনযাপন না করা, কতগুলি বিষাক্ত ভাইরাসের (এইচ আই ভি, এইচ পি ডি, হেপাটাইটিস) সংক্রমণ থেকে বাঁচন জন্য পরিষ্কার পরিত্রা থাকা, টিকা গ্রহণ করা, ব্যাভিচারী লোকের যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলা, সবুজ শাক সবজি ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমেরিকান ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির ক্যান্সার সোসাইটির বিশেষজ্ঞগণ ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করেন। ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্যান্দারে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, মাংস ভোজী মানুষদের চেয়ে নিরামিষ ভোজী মানুষের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
যে দুটি মারণব্যাধি বর্তমান বিশ্বের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেসব রোগের কারণ ও প্রতিকারের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্য বাণীতে।
শ্রীশ্রী ঠাকুরের বাণীগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, উপরে আলোচিত চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে বাণীগুলিতে। ‘স্বাস্থ্য ও সদাচার- সূত্র’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রথমেই বললেন ‘সুস্থ থাকার আচরণই সদাচার, তাই সদাচার পালন কর, সুস্থ থাকো।’ রোগে পড়ে আরোগ্য হওয়ার চাইতে প্রতিষেধক ঢের ভালো অর্থাৎ রোগ যাতে না হয় তাই-ই করা ভালো।’ অর্থাৎ প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর। ক্যান্সার ও হৃদরোগের কারণ ও প্রতিকারের নতুন দিগন্ত উদঘাটিত হয়েছে তার একটি বাণীতে, “মাছ মাংস খাসনে আর পিঁয়াজ রসুন মাদক ছাড়।” আমিষ খেলেই রোগের সৃষ্টি হয়, তাই নিরামিষ খাদ্যই শ্রেয়।” “আমিষ আহার হতে যথাসম্ভব দুরেই থেকো যা তোমার জীবনের পক্ষে বিষ উদগিরণী ও আয়ু অপলাপী। কোন খাদ্য মানুষের শারীরের জন্য উপকারী তা বলতে গিয়ে বললেন-আমার মতে চাল ডাল শাক সবজি শারীর কোশের সাথে অসম্মিলন যাদের নাই, যা সহজ গ্রহণযোগ্য তাই-ই ভালো।
অলস জীবন যাপন ও নিয়মিত শারীরিক শ্রমের অভাবে হানরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। তাই শ্রীশ্রী ঠাকুর সতর্ক করলেন আরাম প্রত্যাশী হয়ো না, বিশ্রামলোভী হতে যেও না, শ্রম- ক্লেশ সুখতায় মাদিত কৃতী সন্ধেগে নিজেকে উজ্জল করে তোল।” “যখনই দেখছো শরীর ও মনে আয়েস প্রচেষ্টা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে, শ্লথ ও অবসন্ন হয়ে উঠেছে তোমার শরীর ও মন, বুঝে নিও তুমি দুর্বল হয়ে উঠছ ক্রমশাই, অবসাদে অভিভূত হওয়া অসুস্থ হয়ে উঠার আগমনী সংকেত।
মানসিক অশান্তি ও টেনশন থেকেও যে হাসারোগের সৃষ্টি হয় তার প্রমাণ মিলে আমেরিকান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ ফল থেকে। তাই শ্রীশ্রী ঠাকুর বললেন- যেকোন ভাবই হোক না কেন, যা ধাক্কা দিয়ে মানসিক বিকার সৃষ্টি করে তা অসুস্থি বা অপকর্ষ প্রদান করে প্রায়শই।” মহিলা ও পুরুষ উভয়েরই অনিয়ন্ত্রিত ব্যাভিচারী চলনার দরুণ শরীরে কিছু বিষাক্ত ভাইরাস বাসা বাঁধে যা থেকেও ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। তাই শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র স্মরণ করিয়ে দিলেন- “সদাচারে রত নয়, পদে পদে তার ভয়। সদাচারে বাঁছে বাড়ে লক্ষ্মী বাঁধা তার ঘরে ।” পরের গামছা কাপড় পরা বিছানা বালিশে শোওয়া, ব্যাধির বিপাক দুর্দশাকে কুড়িয়ে দেহে নেওয়া। একই পাতে অনেকজনে ছোঁয়াছুয়ি করে খাওয়া, এটা কিন্তু রোগবাহী অভ্যাসেরই লাই দেওয়া।”
এমনতর হাজার হাজার বাণীর মাধ্যমে শ্রীশ্রী ঠাকুর বিভিন্ন মারণব্যাধির কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলের আলোকে বাণীগুলিকে বিচার করলে দেখা যাবে শ্রীশ্রী ঠাকুরের বাণীগুলি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তাই বাঁচা বাড়ার অন্যতম নীতি স্বাস্থ্য ও সদাচার মেনে চলাই বাঞ্ছনীয় এবং রোগব্যাধি থেকে নিজেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় দেখিয়ে দিলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র।