হিল্লোল দত্ত: ভাষার অধিকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গ। তাই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে হবে। জোর দিতে হবে মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের ওপর। মাতৃভাষা চর্চা থেকে সরে গেলে আমাদের পরিচয়হীন জাতিতে পরিণত হতে হবে। আজ ১৯শে মে ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে এই মূল্যবান কথাগুলি উচ্চারণ করেন বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম প্রসাদ দত্ত। এদিন রবীন্দ্রসদন মহিলা কলেজে ভাষা শহিদ স্মারক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মুখ্য বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি আরও বলেন, আবহমানকাল ধরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি তার প্রতিবেশী ভাষাকে আপন করে নিয়েছে। কখনও প্রতিবেশী ভাষার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে বাংলা ভাষা। এহেন উদার মন ও মানসিকতাসম্পন্ন বাংলা ভাষা ও বাঙালির ওপর প্রথম আঘাত নামে ১৯১২ সালে। বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল মানভূমের একাংশ অন্তর্ভুক্ত হয় বিহারের সঙ্গে, বাংলা ভাষার ওপর আগ্রাসন চালায় হিন্দি ভাষা। এরপর দেখা গেছে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য রফিক-বরকতের আত্মবলিদান। একই ভাষায় নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য আমরা স্বচক্ষে দেখলাম শিলচর রেলস্টেশনে ১৯৬১ সালে এগারোজন বাঙালিকে প্রাণ দিতে। এরপরও এই উপত্যকার পবিত্র মাটিতে ১৯৮৬ সালে ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জগন-যিশুকে প্রাণোৎসর্গ দিতে হয়েছে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি আত্মবলিদান দিয়েছিল বলেই আজ বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদালাভ করতে পেরেছে। এতো আন্দোলন আর রক্তপাতের পরও ভাষিক আগ্রাসন বহমান বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাই তিনি নব প্রজন্মকে মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধ থাকার এবং উনিশের চেতনায় জেগে ওঠার আহ্বান জানান।
মুখ্য বক্তার পাশাপাশি এদিন তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন উনিশের ভাষা-সেনানী সতু রায়। তাঁর হাত ধরেই এদিন কলেজে স্থাপিত ভাষা শহিদ স্মারক উন্মোচিত হয়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় উনিশের ভাষা আন্দোলনের স্বরূপ তুলে ধরেন। কোনও ধরনের রক্তপাত না ঘটিয়ে বাঙালিররা সেদিন কীভাবে সত্যাগ্রহ ও অহিংস পন্থায় গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা তিনি তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই বাঙালি আগ্রাসনের শিকার যার থেকে বাঙালি আজও মুক্তি পায়নি। তাই আমাদেরকে হিন্দু-মুসলিম সত্তা দূরে সরিয়ে রেখে বাঙালি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে প্রতি মুহুর্তে।
উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক তথা কলেজ পরিচালন সমিতির সদস্য কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ বলেন, বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি আমরা শিখতেই পারি। তাই বলে নিজের মাতৃভাষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে আমরা কোনওমতেই অবহেলা করতে পারি না। প্রসঙ্গেক্রমে নতুন শিক্ষানীতিতে মাতৃভাষাককে প্রাধান্য দেওয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষে রবীন্দ্রসদন কলেজ যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে তিনি সাধুবাদ জানান।
ভাস্কর-শিল্পী স্বপন পাল বলেন, মানুষের প্রয়োজনেই শিল্প তৈরি হয়। এবং, শিল্পের মাধ্যমে তিনি নিজেও প্রতিবাদ করেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. নিবারণ চন্দ্র দাস ভাষা শহিদ-স্মারকটিকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দেন কলেজের ছাত্রীদের। শহিদ-স্মারকটি তার কাছে মাতৃতুল্য বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সভাপতির ভাষণে ড. মৃণালকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, বরাক উপত্যকা একটি বহুভাষিক ভূখণ্ড। বরাকের এই বৈচিত্র্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে ছাত্রীদেরকে সেদিকে নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি। সেইসঙ্গে, উনিশের ভাষা আন্দোলনে কমলা ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই কথাও তিনি ছাত্রীদের স্মরণ করিয়ে দেন।
স্বাগত ভাষণে অধ্যক্ষ ড. সব্যসাচী রায় বলেন, এই শহিদ-স্মারক শুধু বাংলা ভাষা ও বাঙালিরর নয়, এই স্মারক সব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের। এই স্মারক মাতৃভাষা সৌধ। উনিশের ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, মূলত গরীব, নিম্নবিত্ত মানুষরাই ভাষাকে রক্ষা করে আসছেন। বরাকের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে কলেজে আগত ছাত্রীরা নির্দ্বিধায় বাংলা ভাষা চয়ন করছে বলে তিনি ছাত্রীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। শহিদ-স্মারক নির্মাণে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রীরা যেভাবে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছেন তিনি তার জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান। আগামীতে কলেজের কার্যসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দেওয়ালচিত্র, রবীন্দ্র চর্চাকেন্দ্র ও সুজিৎ চৌধুরী আর্কাইভ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তির মাধ্যমেও ভাষা শহিদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কলেজের ছাত্রী রাজলক্ষ্মী দাস, নয়নিকা চক্রবর্তী ও পল্লবী দাস। নৃত্য পরিবেশন করেন পূজা পোদ্দার, দিয়া চক্রবর্তী, বিদিয়া চক্রবর্তী ও জ্যোতি মালাকার। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অধ্যাপিকা প্রজ্ঞা অন্বেষা ও ছাত্রী পল্লবী দাস। এদিন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপিকা প্রজ্ঞা অন্বেষা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি কোষের আহ্বায়ক ড. রাজদীপ চন্দ।
এদিন কলেজে শহিদ-স্মারক উন্মোচিত হবে বলে কলেজের প্রত্যেকেই আনন্দিত, আবেগপ্রবণ ও উদ্বেলিত ছিল। বর্তমান ও প্রাক্তন সকল শিক্ষক-ছাত্রীদের উপস্থিতিও ছিল নজরকাড়া। উপস্থিত ছিল কলেজের এনসিসি ও এনএসএস বিভাগের ছাত্রীরা। এছাড়া, কলেজের গ্রন্থাগার বিভাগের পক্ষ থেকে প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়।।