আমি বললাম-আর পূজা করতে বড় ইচ্ছা হয় না। আর কাকে, কোন্ দেবতাকেই বা পূজা করতে যাব?
শ্রীশ্রীঠাকুর হাসতে লাগলেন। কিয়ৎকাল পরে নিজেও অঞ্জলি দেবেন এবং আমাদেরও দেওয়াবেন ব’লে নাইতে চললেন। আমি বললাম-ওটা কি লোকাচার রক্ষা? বাউলদের কথায় আছে-
লোক-মধ্যে লোকাচার।
সদগুরুর পাশে একাচার।।
শ্রীশ্রীঠাকুর- “কথাটা মিথ্যা নয়, লোকাচারই রক্ষা কতকটা! যাতে নিজের ক্ষতি নাই, কিন্তু সমাজের লোকের, নিম্নাধিকারী লোকের মঙ্গল, এরূপ লোকাচার বা সমাজধৰ্ম্ম মানাই ভাল। সকলে তো উচ্চতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু যারা বোঝে তারা সকলে অনাবশ্যক বোধে যদি হঠাৎ সব বাহ্যপূজাদি ছেড়ে দেয়, নীচের লোকেরাও তাহ’লে দেখাদেখি ছেড়ে দেবে, কিন্তু উচ্চতত্ত্ব বুঝতে ও ধারণা করতে পারবে না, কাজেই তাদের ক্ষতি হবে।
“প্রকৃত সরস্বতী-পূজা হ’চ্ছে ভজন। অনাহত সদাবিরাজিত শব্দ-ধারা যাহা সাধন-ফলে নিজ অভ্যন্তরে জাগরিত হয় এবং শ্রুত হয় তাতে প্রক্রিয়াবিশেষ যোগে মনোনিবেশ করাকে ভজন কহে। আজ বাইরে বৈখরী শব্দযোগে গীতবাদ্যাদি এবং ভজনযোগে খুব অভ্যন্তরস্থ শব্দে মনোনিবেশ করাই সেই পরাবাক্ বা পরশব্দরূপিণী সরস্বতীর পূজা। কিন্তু সকলে তো এ বোঝে না এবং জানে না-তাদের অধম হলেও বাহ্যপূজা করা বাদ নয়।
অতঃপর স্নানাদি ক’রে আমি ও শ্রীশ্রীঠাকুর অঞ্জলি দিতে গেলাম। তাঁর জনৈক ভক্ত-অবিনাশদা হাসতে-হাসতে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরও তাই ব’লে অঞ্জলি দিচ্ছেন। তাঁর একটু পশ্চাতে আমিও পুষ্পাঞ্জলিহস্তে হাঁটু গাড়িয়া ব’সে আছি। কিন্তু ও-মন্ত্র কি পড়বো, মনে-মনে মহামন্ত্র-তাঁর আদি ধ্বন্যাত্মক নাম বলিতেছি মাত্র। আর, ভাবিতেছি অঞ্জলি দেব কোথায়! সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ দেবতা ভবভয়হারী-যিনি পরাবাক্ সরস্বতীরও জনক, যাঁহা হ’তে শব্দব্রহ্মরূপিণী সরস্বতীর উৎপত্তি সেই আদি পুরাণপুরুষ পরমপিতার যে নরবিগ্রহ আবির্ভূত সেই বিগ্রহ-চরণে-না ঘটাধিষ্ঠিতা দেবীর চরণে। কিন্তু দেখিতেছি স্বয়ং তিনি তো লোকধৰ্ম্ম, সমাজধৰ্ম্ম পালনার্থে ঘটেই অঞ্জলি দিচ্ছেন এবং তাঁর আজ্ঞাই শিরোধার্য্য। তাই সেই রাতুল-চরণে অঞ্জলি দেবার লোভ সম্বরণ ক’রে ঘটেই অঞ্জলি দিলাম।
এই কথাগুলি একান্তে ব’সে লিখতেছি, এমন সময় শ্রীশ্রীঠাকুর সহসা এসে আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে গলা জড়িয়ে ধ’রে গান ক’রে বললেন-
দে তুলে দে পাল।
দেখবি, দয়াল আজি
দয়া ক'রে
ধরবে এসে হাল।
তারপর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ পেয়ে তাঁর সঙ্গে ফিরে আশ্রমে আসতেছি। বললেন- “আর সকলকে আপনি মন্ত্র পড়িয়ে অঞ্জলি দেওয়ান; আপনাকেই আজ পুরোহিত-পদে পাকাপাকি সায়েত করিয়ে দিই; ব্রাহ্মণ পর্য্যন্ত যজিয়ে দেন আজ!” তারপর কিশোরীদা, বিরাজদা, যোগেন সরকার, যতীন, সুরেন প্রভৃতি ১২।১৪ জন স্নানান্তে এলে তাঁর আদেশ-মত আমি মন্ত্র পড়লাম, তারা অঞ্জলি দিল। মনে-মনে ভাবছি, যদি পুরোহিত কর তবে তোমার রাতুল-চরণে যাতে জগৎবাসীকে অঞ্জলি দেওয়াতে পারি, সেইরূপ পুরোহিত এই অধমকে নিজ কৃপাবলে কর। আর, দেবদেবীর পূজার পুরোহিতগিরি করতে ইচ্ছা নাই। অহৈতুক কৃপাসিন্ধু, পতিতপাবন, তোমারই পূজার পুরোহিত যেন হই।
-অশ্বিনীকুমার বিশ্বাস
সূত্র: অমিয়বানী, ১২ই মাঘ, সোমবার ১৩২৬