রাষ্ট্রের স্বার্থে দল ত্যাগ আইন কঠোর করা হোক,যা গণতন্ত্রের পরিপূরক।
তন্ময় ভট্টাচার্য, কলকাতা,১২ মার্চ: ভারতীয় রাজনীতি অথবা রাজ্য রাজনীতিতে যখন তখন দল কিংবা রঙ বদলানো এখন স্বাভাবিক ছন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দল ছেড়ে ওই দল, আবার ওই দল ছেড়ে এই দল, এখন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউই এ ব্যাপারে কোনরকম ধার ধারছেন না প্রয়োজনমতো একটু বেশি সুবিধা ভোগ করার জন্য যে যখন যেখানে পারছেন চলে যাচ্ছেন। আদর্শ কিংবা দলীয় স্বার্থ তোয়াক্কা না করেই পতাকা বদল করছেন যেমন খুশি ভাবে। দেখা যাচ্ছে কোন একটি দলের হয়ে টিকিট পেয়ে নির্বাচনে জেতার পর যোগ দিচ্ছেন অন্য দলে, আবার অনেকে দলের দীর্ঘ দিনের কর্মী হয়েও ভোটের আগে টিকিট না পাওয়ার রাগে অথবা শুধুমাত্র টিকিট পাওয়ার লোভে অন্য দলের পতাকা ধরছেন। এতে ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ন্যূনতম লজ্জা টুকু নেই। রীতিমতো মাথা উঁচু করে বুক বাজিয়েই করছেন এইসব। কিন্তু সেই সব নেতা,মন্ত্রী অথবা দলীয় কর্মীরা দল বদলের সময় একবারও ভেবে দেখছেন না বা দেখার প্রয়োজন বোধ করছেন না যে এর ফলে আদর্শ এবং নীতিগত দিকটা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেটা কিন্তু সমাজে যথেষ্ট ছাপ ফেলছে। এবং এর ফলে নেতা মন্ত্রীদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসটা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠিকছে। সমাজ বা জাতির অথবা রাজনৈতিক দল গুলোর জন্য একটা ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৭৮ বছরে কিন্তু যেমন খুশি দলবদলের হিড়কটা আগে এতটা দেখা যায়নি। যতটা দেখা যাচ্ছে গত ১০-১১ বছর ধরে। এখনকার সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোও মুখে মতাদর্শ,আদর্শ, সততা,মূল্যবোধ এইসব কথা বললেও তাদের রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে কিন্তু একেবারেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থি কংগ্রেস,বিজেপি,তৃণমূলের নেতা কর্মী হোক অথবা তথাকথিত বামপন্থী সিপিএমের নেতাকর্মী বাস্তবে এদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া কিন্তু কঠিন। যখন তখন জার্সি বদল করার মতো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী জার্সি বদল করছেন। সকালে ডানপন্থী তো বিকেলে বামপন্থী। নেতাকর্মীরা এখন রাজনীতিকে ব্যক্তিগত পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছেন। তাদের কাছে রাজনীতি মানে হচ্ছে মোটা টাকার আকর্ষণ,ব্যক্তিগত উন্নতি, মন্ত্রিত্ব,ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার লোভ। এইসব নেতাকর্মীরা হিসেব কষে দেখেন কোন দলে গেলে কত লাভ!কার পালে হাওয়া বেশি! কোন দল এখন ক্ষমতায়! কোথায় গেলে নিজের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার সুরক্ষিত হবে! কোন দলের ছাতার তলায় থাকলে ব্যক্তিগত লাভ বেশি হবে! দুর্নীতির পর শাস্তি পাবার ভয় থাকবে না কোন দলে আশ্রয় নিলে।এইগুলোই কিন্তু এখন দলত্যাগের প্রধান কারণ আর পাশাপাশিভাবে এখনকার প্রভাবশালী দলগুলিও কিন্তু ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে। কাকে বা কাদের নতুন করে দলে নিলে তাদের ক্ষমতা আরো বেশি করে বাড়বে এবং তারা ক্ষমতা দখল করতে পারবে এই হিসাব নিকাশ করেই কিন্তু তারা নেতাকর্মীদের দল ত্যাগকে মদত দেন। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের এক ঝাঁক নেতা সুযোগের সন্ধানে বিজেপিতে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু বিজেপি হেরে যাওয়ার পর তাদের অনেকেই আবার ঘাস ফুল শিবিরে ফিরে এসেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই দেশে একটা নতুন রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। রয়েছে সুযোগ-সন্ধানি রাজনীতি। এই প্রবণতাই নিজের স্বার্থটাই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মতাদর্শ পড়ে থাকছে পেছনে এবং রাজনীতিটা হয়ে উঠছে লোভনীয় পেশা। সেই কারণে দল বদল করা এখন নেতাকর্মীদের কাছে জল ভাত হয়ে উঠেছে। এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্ম সংক্ষেপে এডিআর দেশের দল বদলুদের নিয়ে সম্প্রতি একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৭৭ জন বিধায়ক ও সাংসদ কংগ্রেস ছেড়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বহুজন সমাজবাদী পার্টি তাদের ১৫৩ জন প্রার্থী দল ত্যাগ করেছেন। আর বিজেপি ছেড়ে গেছেন ৩৩ জন জনপ্রতিনিধি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে রাজনীতি এখন একটা বাজারে পরিণত হয়েছে। জনগণ এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভোট দেওয়ার সময় মানুষ দেখছে যে সে কিভাবে এই দল কিংবা ব্যক্তির থেকে আরও বেশি লাভবান হতে পারেন সেই প্রার্থী দল বদলেছে কিনা বা কতটা আদর্শ তিনি মেনে চলছেন সেটা কিন্তু একবারও ভেবে দেখছেন না। তবে পাশাপাশিভাবে পর্যবেক্ষক এটাও বলছেন যে এইভাবে জার্সি বদলের মতো দল বদল করলে মানুষের জনমতকে লংঘন করা হয়। দলবদল কে বন্ধ করার মতো কোনো শক্তিশালী আইন যেহেতু দেশে নেই তাই আবাধেই চলছে দল বদল। দলবদল মাত্রই কিন্তু যে খারাপ তা কিন্তু নয়,কিন্তু কি উদ্দেশ্যে দল বদল সেটা কিন্তু এটা ভাববার বিষয়। মানুষের ভোটাধিকারের মানে হচ্ছে তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নিজেদের ইচ্ছেমতো বেছে নেবে। বিধানসভায় যাকে ভোট দেবে, লোকসভায় তাকে ভোট নাও দিতে পারে এটাই গণতন্ত্রের সার্থকতা।কিন্তু কোন নেতা যদি তার নিজের স্বার্থে বেশি ক্ষমতাশীল দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে সেটা কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে বিপদজনক। ক্ষমতা আর অর্থ যদি রাজনীতিতে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে তবে তা গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এবং দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে। কেননা এই পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবস্থার ক্ষয় হয় এবং একনায়কতন্ত্র বা সামরিক শাসনের অবস্থা তৈরি হয়। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র দল নির্ভর যদি নেতা-নেত্রীদের দল বদলু মনোভাবের জন্য এ ব্যবস্থা আদর্শ শুন্যতা হয়ে পড়ে তাহলে গণতন্ত্রের প্রতি কিন্তু মানুষের শ্রদ্ধা কমে যাবে। আধুনিক রাজনীতির সহজ সংজ্ঞা হচ্ছে নিজেদের আখের গোছানো।নেতা নেত্রীরা নীতিহীন রাজনীতি ও ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি হিসেবের মধ্যে দিয়ে জনগণের আস্থা বিশ্বাসকে যেমন আঘাত করছেন ঠিক তেমনি রাজনীতির সম্পর্কে জনগণের মনে অশ্রদ্ধা ও গড়ে তুলছেন। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর জনগণ আস্থা হারাচ্ছেন। এর দায় কে নেবে। সংশ্লিষ্ট দল ও নেতাদের ওপর কি এই দায় পড়ে না। সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী আইন আছে কিন্তু সেই আইন এর নানা ফাঁক গুলিতেই দলত্যাগ কিন্তু চলছে। ভারতীয় রাজনীতিতে আয়ারাম গয়ারাম কথাটা দেশ চালু আছে। কিন্তু এই আয়া রাম আর গয়ারাম এর জন্যেই কি রাজনীতিতে আদর্শ ও বিশ্বাসের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। দলের থেকে ব্যক্তি বড় হয়ে যাচ্ছে। আর নিজেদের প্রয়োজনে ক্ষমতা দখলের জন্য ভোটের স্বার্থে সেটাকেই কে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যক্তিকে ব্যবহার করা কিংবা জনগণের কাছে তার ছায়া চকচকে পরিচিতি কে ব্যবহার করার প্রবণতা ইদানিং কালে একটু বেশি রকমের বেড়েছে।এতে দেশ ও জাতির অনেকটাই ক্ষতি হচ্ছে। ভারতীয় রাজনীতিতে দল বদলানোর রাজনীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।সৎ ও নির্ভিক রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের রাজনৈতিক আসা প্রয়োজন।তবেই ভারতবর্ষ আরো এগিয়ে যাবে।তাই দেশে এমন কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন, যা গণতন্ত্রের পরিপূরক হবে বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।