অমিতাভ নাথ,
ভাষাবিদ ও প্রাচীন পুঁথি গবেষক হরকুমার শাস্ত্রী নেপালের রাজপরিবারের পুঁথিঘরে (লাইব্রেরি) আবিষ্কৃত “চর্যাপদ” নামের গান ও কবিতা মিশিয়ে এক আধো বুঝা ‘আধো নাবুঝা’ ভাষার বইটিই যদি হয়’ বাংলা, উড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার প্রাচীনতম প্রামাণ্য পুঁথি তবে বাংলা ও অসমিয়া ভাসা মুখের পরিবর্তনে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হলেও ভিত্তি সেই দেবভাষা সংস্কৃত। সংস্কৃত থেকে বিবর্তিত হয়েই অধিকাংশ ভারতীয় ভাষা আজকের রূপ নিয়েছে। এটি স্বীকৃত ও মান্য।
ভাষার বিবর্তন স্বাভাবিক। ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা বিষয় নয়। সংস্কৃতিকে ঘিরেই ভাষার পথচলা। ভাষা তাই সংস্কৃতির ভাষ্য। সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে। আগলে রাখে আর ছড়িয়ে দেয় পরবর্তী প্রজন্মে।
সময়ের হাত ধরে সংস্কৃতি নিজেকে বিবর্তিত করে। রূপ বদলে নেয়। সুরের বিভিন্নতা আসে। অথচ মূল কাঠামো অক্ষত থাকে। ঠিক তেমনি ভাষা। বাংলা ও অসমিয়া ভাসিক সংঘাতের কারণ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর আগ্রাসনবাদী নীতি ও প্রভুত্ববাদ (ভাষিক প্রভুত্ববাদ)। একে বাড়িয়ে দিয়েছে অস্তিত্ব ও শেকড়কে উপেক্ষা ও অস্বীকার। সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি।
১৯৪৭ সালের পর থেকে পুনর্নির্মাণের (Re-construction) পথে না হাঁটাই এমনি সমস্যার পাহাড় গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় পুনর্নিমাণ ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ এইসব সমস্যাকে সমাধানের পথ দেখাতে পাবে। সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস পাঠ করিয়ে প্রজন্মকে পঙ্গু করা হয়েছে। ভাষাবিদদের মতেই চল্লিশ মাইল পথ পেরোলেই একই ভাষায় কিছু পরিবর্তন আসে। শব্দগত বা উচ্চারণ গত। ছোট্ট উদাহরণ:- বরাকের কাছাড়ি বলি , বা সিলেটিই বলি বাংলায় গন্ধথাকা লেবুর একটি প্রজাতিকে বলা হয় “শাসনি লেবু”। যাকে শিলচরে বসে আমি উচ্চারণ করছি।
“শাসনি লেবু”। অথচ আমারই কিছু পরিচিত কাটিগড়া বা ভাগা-বাজার এলাকার লোকেরা বলেন- “শাছনি লেবু”। ভাষা এক শুধু উচ্চারণগত এই ‘চ’ আর ‘স’-র পার্থক্য। বানান তো লিখছি একই। উপেক্ষা করি তাই এই ছোট্ট পার্থক্য খেয়াল করিনি। এমনি খেয়ালের অভাব ও কিছু কিছু উপেক্ষাই একই মায়ের দুই বোনকে বিচ্ছিন্ন করেছে। দুই তরফেই উপেক্ষা ও অ-সমন্বয়ের মনোভাবের ফাঁক খুঁজে ঢুকেছে মৌলবাদীদের ছায়াযুদ্ধের ইন্ধন। স্বাধীন অসমের নামে নরহত্যা তো দেশকে ভাষার নামে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা। সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে পঙ্গু করা। ভাষা বিবাদের মুখোশের আড়ালে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ জমি দখলে ব্যস্ত। আলফার প্রচার সচিব সেই নব্বই দশকে (গত শতকের) দাবী করেছিলেন, ভারত একটি বহুভাষী রাষ্ট্রের যুক্ত কাঠামো। এমনি সব তাত্ত্বিক প্রচারের পেছনে সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সমন্বয়কে অস্বীকারের প্রচেষ্টা। বহুভাষী ভারতের সমন্বয় সংস্কৃতির মাধ্যমেই সম্ভব। এক দেশ এক রাষ্ট্র ভাবনার চেতনা তখনি সম্ভব যখন একে স্বীকার করতে পিছপা হবো না যে সংস্কৃত মাতারই দু’কন্যা অসমের ‘অসমীয়া’ ও ‘বাংলা’ ভাষা।
বাঙালি আর অসমিয়ার নামে সংঘাতের চোরাস্রোত আর বইতে দেওয়া মানে সময়ের দাবিকে অস্বীকার করা। মতের অমিল সত্ত্বেও ডঃ অমলেন্দু গুহ-র মতো একবার বলতে পারি না, “অসম ন-মরে” আমিও “ন মরো” ।।