তন্ময় ভট্টাচার্য, কলকাতা:: আমাদের শাস্ত্রে বিশেষ করে স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে সুস্পষ্টভাবে শ্রীরাম জন্মভূমি অযোধ্যার অবস্থান এবং মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। অত্যন্ত পবিত্র পুরী অযোধ্যা। এ অযোধ্যাতেই সূর্যবংশীয় ইক্ষ্বাকু, দিলিপ, রঘু, দশরথ, রাম প্রমুখ রাজারা যুগযুগ ধরে রাজত্ব করে ধর্মরাজ্যের স্থাপনা করেছেন। কিন্তু সকল রাজাদের ছাপিয়ে গিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র। তাই আজও তিনি মনুষ্যকুলের আদর্শ বলে মর্যাদাপুরুষোত্তম বলা হয়। মঙ্গলময় তাঁর স্বরূপ, তাই তাঁকে রামভদ্রায় বলে। ধরিত্রীর অজ্ঞানের অন্ধকারে চন্দ্রের মত তিনি শোভমান, তাই তাঁকে রামচন্দ্রায় বলে।
রামায় রামভদ্রায় রামচন্দ্রায় বেধসে।
রঘুনাথায় নাথায় সীতায়াঃ পতয়ে নমঃ।।
স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে ভারদ্বাজ প্রমুখ অমল মুনিগণ ব্যাসশিষ্য রোমহর্ষণ সূতের কাছে পবিত্র অযোধ্যা নগরীর মাহাত্ম্য সবিস্তারে জানতে চাইলেন। তাঁরা রোমহর্ষণ সূতকে বললেন, “হে মহাভাগ, মহাপুরী সতত পবিত্রা বিষ্ণুপ্রিয়া অযোধ্যাপুরীর মাহাত্ম্য সবিস্তারে আমাদের বলুন।”
তখন ব্যাসশিষ্য রোমহর্ষণ সূত সবিস্তারে অযোধ্যা মাহাত্ম্য বলতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, অযোধ্যা নগরী এতটা পবিত্র স্থান, যে স্থানে দুষ্কৃতকারীরা বসবাস করতে পারে না; স্বয়ং শ্রীহরি সেখানে মূর্তিমান হয়ে বিরাজ করেন। রোমহর্ষণ সূতের কথার সত্যতা আমরা ইতিহাসেও দেখি। বিভিন্ন সময়ে অনেক দুষ্কৃতকারী তাদের বিভিন্ন দুষ্কর্ম দিয়ে অযোধ্যাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা সর্বদাই অসফল হয়েছ। অযোধ্যা আরও বেশী সর্বগ্রাসী রূপ ধরে জ্বাজ্জল্যমান হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা হয়ত জানেনা, অযোধ্যাতে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজমান।
অযোধ্যা সা পরা মেধ্যা পুরী পুরী দুষ্কৃতিদুর্লভা।
কস্য সেব্যা চ নাযোধ্যা যস্যাং সাক্ষাদ্ধরিঃ স্বয়ম্।।
সরযূতীরমাসাদ্য দিব্যা পরমশোভনা।
অমরাবতীনিভা প্রায়ঃ শ্রিতা বহুতপোধনৈঃ।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড,অযোধ্যা, প্রথম অধ্যায়,৩০-৩১)
” যে স্থান অত্যন্ত পবিত্র, যে স্থানে দুষ্কৃতকারীরা বসবাস করতে পারে না; যেখানে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজ করেন, এমন পবিত্র অযোধ্যা পুরীর কে না সেবা করতে চায়? স্বর্গের নগরী অমরাবতীর মত পরম শোভাশালিনী দিব্যপুরী অযোধ্যা সরযূনদীর তীরে অবস্থিত।এ পুরীর সর্বত্রই তপধনগণ সুখে বসবাস করেন।”
পবিত্র অযোধ্যা নগরী দেবরাজ ইন্দ্রের ইন্দ্রপুরীর অনুকরণে নির্মিত। ইক্ষ্বাকুপ্রমুখ সূর্যবংশের রাজাগণ এখানে জন্মগ্রহণ করে রাজত্ব করেছেন। এ নগরী পবিত্র সরযূ নদীর তীরে স্থাপিত। অত্যন্ত পবিত্র এ সরযূ নদী মানস সরোবর হতে জাত এবং ভগবান বিষ্ণুর বাম অঙ্গুষ্ঠ হতে নিঃসৃত। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এ নদীর সাথে মিশে আছেন। ভগবান তাঁর পুরুষোত্তম লীলা সংবরণ করে এ নদীতে ডুব দিয়েই তিনি মহাপ্রস্থান করেন। মহাপ্রস্থানের পূর্বে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ভক্ত হনুমানকে দায়িত্ব দিয়ে যান সকল রামভক্তদের সর্বদা রক্ষা করতে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলেন,”হে বায়ুতনয়, তুমি চিরজীবী হবে, যে পর্যন্ত লোক সকল আমার কথা কীর্তন করবে, তুমি আমার প্রতিজ্ঞা পালন করতে ততকাল জীবন ধারণ করবে।” এ কারণেই আমরা আজও দেখি যেখানেই শ্রীরামচন্দ্র সেখানেই ভক্ত হনুমান। আগে ভক্ত হনুমানকে স্মরণ করেই, পরে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের শরণ নেই আমরা।
ওঙ্কার শব্দে যেমন সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের অধিপতি ব্রহ্মা বিষ্ণু এবং রুদ্র বিরাজ করে ; তেমনি অযোধ্যা শব্দটির মধ্যেও এ ত্রিদেব বিরাজ করেন। তাই অযোধ্যা নাম স্মরণেও মহাপুণ্য হয়।অযোধ্যা শব্দের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে অগস্ত্য ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে বলেছেন:
অকারো ব্রহ্ম চ প্রোক্তং যকারো বিষ্ণুরুচ্যতে।
ধকারো রুদ্ররূপশ্চ অযোধ্যানাম রাজতে।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা,১. ৬০)


“শাস্ত্র বলে, ‘অ’-কার ব্রহ্ম, ‘য’-কার বিষ্ণু এবং ‘ধ’-কার রুদ্রের রূপ; অযোধ্যা এ বর্ণত্রয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু রুদ্র সতত বাস করে।”
অসংখ্য ঋষি, মুনি এবং মহাত্মারা অযোধ্যাতে সাধনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে বেদ বেদাঙ্গে পারঙ্গম বিষ্ণুশর্মা প্রধানতম। তিনি তীর্থযাত্রা উপলক্ষে পর্যটন করতে করতে অযোধ্যার চক্রতীর্থে এসে, ইন্দ্রিয়কে সংযত করে কঠোর তপস্যা করেন। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁকে দর্শন দিয়ে বলেন, “আমার নামের আগে তোমার নাম যুক্ত হয়ে, অযোধ্যার চক্রতীর্থে আমার মূর্তি বিষ্ণুহরি নামে খ্যাত হবে এবং ভক্তদের মুক্তি দান করবে।” সেই থেকে ভগবানের বিগ্রহ অযোধ্যার চক্রতীর্থে বিষ্ণুহরি নামে সদা খ্যাত হয়ে জীবকে মুক্তি দান করছে।
পুরাকালে পিতামহ ব্রহ্মাও অযোধ্যায় চক্রতীর্থে বাস করেছিলেন। তিনি তখন নানা দেবতাদের সাথে নিয়ে এক বৃহৎ কুণ্ড নির্মাণ করে এক পবিত্র যজ্ঞ করেছিলেন। পিতামহ ব্রহ্মার দ্বারা তৈরি হওয়ায় সেই কুণ্ডের নাম হয় ব্রহ্মকুণ্ড। ভগবান ব্রহ্মা প্রতিশ্রুতি দেন তিনি সতত এ কুণ্ডে বাস করবেন। এ ব্রহ্মকুণ্ড চক্রতীর্থের পূর্বদিকে অবস্থিত।
স্কন্দ পুরাণে অগস্ত্য ঋষি কতৃক স্বর্গদ্বার এবং মুক্তিদ্বার তীর্থ সহ অযোধ্যাতে অবস্থিত অসংখ্য তীর্থের বর্ণনা এবং মাহাত্ম্য বিস্তৃতভাবে দেয়া আছে। প্রত্যেকটি তীর্থের ভৌগোলিক বর্ণনাও দেয়া আছে। তীর্থক্ষেত্রগুলো অযোধ্যা বা সরযূ নদীর কোন পাশে, কোন কোণে এবং কতটা দূরত্বে অবস্থিত; এ বিষয়ে অগস্ত্য ঋষি বিস্তারিত বলেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে। অযোধ্যাতে সরযূ ও ঘর্ঘরসঙ্গমে স্নান মাহাত্ম্য অপরিসীম। এছাড়া অযোধ্যাক্ষেত্রে বিভিন্ন তীর্থ বিরাজমান। তীর্থগুলো হল:গোপ্রতার তীর্থ, ক্ষীরোদ তীর্থ , ধনযক্ষ তীর্থ , বশিষ্ঠকুণ্ড, যোগিনী কুণ্ড, ঊর্বশীকুণ্ড, ঘোষার্ককুণ্ড, রুক্মিণীকুণ্ড, বৃহস্পতিকুণ্ড, সাগর কুণ্ড, রতি কুণ্ড, কাম কুণ্ড, সুগ্রীব তীর্থ, বিভীষণ সরোবর,গয়াকূপ, ভরতকুণ্ড,ভৈরব কুণ্ড, জটাকুণ্ড, শ্রীরামজন্মস্থান প্রমুখ।
অযোধ্যাতে তিলোদকী সঙ্গমের পশ্চিমে সরযূতীরে সর্বকামদ একটি বিখাত তীর্থ রয়েছে; এ তীর্থের নাম সীতাকুণ্ড। স্বয়ং সীতাদেবী এ কুণ্ড নির্মাণ করেছিলেন।মানব এ সীতাকুণ্ডে স্নান করে নিখিল পাপ থেকে মুক্ত হয়। অত্যন্ত পবিত্র এ তীর্থ। সাধারণত একই নামে দুটি তীর্থ থাকেনা। সীতাকুণ্ড নামে চট্টগ্রামে অন্য আরেকটি তীর্থ আছে। তীর্থটি প্রধানত দেবীপীঠ। দেবীর নাম ভবানী এবং ভৈরবের নাম চন্দ্রশেখর। চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ড তীর্থটি দেবী সীতার সাথে সম্পর্কিত কিনা এবং সীতাদেবী বনবাসকালে বঙ্গে এসেছেন কিনা ; বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানকালে আমরা দেখতে পাই, বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ডের অনুসরণে, ওখানকার মাটি জল নিয়ে এসে বৈষ্ণবেরা বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধুসন্তগণ বিভিন্ন স্থানে রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড স্থাপন করেন। বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডে ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কোন সাধুসন্ত হয়ত অযোধ্যার সীতাকুণ্ড থেকে মাটি জল নিয়ে এসে, চট্টগ্রামে স্থাপন করে সীতাকুণ্ড তৈরি করেছে। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব নয়। সকলই অনুমান। তবে বিষয়টি নিয়ে আগামীতে বৃহত্তর পরিসরে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
অযোধ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান হল শ্রীরামজন্মভূমি। এ জন্মভূমি প্রসঙ্গে স্কন্দ পুরাণের অযোধ্যামাহাত্ম্য অংশে, জন্মভূমির অবস্থানের ভৌগোলিক বর্ণনা সহ মাহাত্ম্য দেয়া আছে। সেখানে জন্মভূমির অবস্থান সম্পর্কে অগস্ত্য ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে বললেন:
“বিঘ্নেশের ঈশানকোনে মোক্ষাদি ফলসাধন শ্রীরামজন্মস্থান বিদ্যমান। বিঘ্নশের পূর্বে, বশিষ্ঠের উত্তর, ও লৌমশের পশ্চিমে জন্মস্থান অবস্থিত। এ স্থান দর্শনে মানবের গর্ভবাস দূর হয়। জন্মবন্ধন থেকে মানব মুক্ত হয়। জন্মভূমির দর্শন মাত্রই প্রতিদিন সহস্র সহস্র কপিলা গোদানের ফললাভ হয়ে থাকে।আশ্রমবাসী তাপসের যে পুণ্য; সহস্র রাজসূয় যজ্ঞে যে পুণ্য; প্রতি বছরে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করলে যে ফল লাভ হয়; মানব শুধুমাত্র নিয়ম করে শ্রীরাম জন্মভূমি দর্শন করলেই সে সকল পুণ্য লাভ করে। সাধু চরিত্র ব্যক্তি মাতা,পিতা ও গুরুজনের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে যে ফল লাভ হয়, জন্মভূমির দর্শনেই সে ফল লাভ হয়। সরযূদর্শনে পিতৃগণের অক্ষয় তৃপ্তি, গয়াতে শ্রাদ্ধ হতেও, সরযূ দর্শনের ফল অধিক।”
এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, বিঘ্নেশ তীর্থের পূর্বে, বশিষ্ঠ কুণ্ডের উত্তরে এবং লৌমশ তীর্থের পশ্চিমে শ্রীরাম জন্মস্থান অবস্থিত। পুরাণে বর্ণিত অবস্থানে বর্তমানেও অযোধ্যা ঠিক একইভাবে আছে। অযোধ্যা একটি মন্দিরের নগরী। আজও হাজার হাজার মন্দির পরিবেষ্টিত আছে শ্রীরামজন্মভূমি। পুরাণের সাথে বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থানের সম্পূর্ণ মিল পুরাণের সত্যতা প্রমাণ করে। অগস্ত্য ঋষি জন্মভূমির অবস্থানের বর্ণনা করে, তিনি এ জন্মভূমি দর্শনের অপরিসীম মাহাত্ম্যের কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন।
যে কোন মানবের জীবনে একবার হলেও এ অযোধ্যাতে অবস্থিত শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থ দর্শন করা উচিত। স্বচক্ষে অযোধ্যাকে দর্শন করতে যদি অসম্ভব হয়, তবে ঘরে বসে হলেও পুণ্যভূমি অযোধ্যাকে স্মরণ করা উচিত। শাস্ত্রে বলা আছে, “অযোধ্যা স্মরণে শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।”
যত্র কুত্র স্থিতো যস্তু হ্যযোধ্যাং মনসা স্মরেৎ।
ন তস্য পুনরাবৃত্তিঃ কল্পান্তরশতৈরপি।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, দশম অধ্যায়, ৩৪)
” মানব যেখানেই থাকুক না কেন, মনে মনে অযোধ্যাকে স্মরণ করলেও, তার শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।”
২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমি অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমি দর্শনে যাই।শ্রীরামজন্মভূমি অযোধ্যাতে গিয়ে এত ভাল লেগেছিল, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। মনে হয় জীবনে এমন আনন্দের দিন খুব কমই এসেছে। অযোধ্যার রাস্তায় হাটতে হাটতে বারবার মনে হচ্ছিল, এই সেই অযোধ্যার রাজপথ যে পথ দিয়ে রাবণকে বধ করে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দীপাবলির দিনে বীরবেশে অযোধ্যায় প্রবেশ করেছিলেন। সারা অযোধ্যাবাসী অযোধ্যাপতির আগমনে আনন্দঘন হয়ে ছিলেন। তাঁদের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। মঙ্গলঘট, প্রদীপসহ বিবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্যে সুসজ্জিত হয়ে ছিল সম্পূর্ণ অযোধ্যা নগরী। লাখো লাখো প্রদীপের আলোয় প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল অযোধ্যা। প্রদীপের আলোর শোভায় দিন না রাত্রি ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। অযোধ্যা স্বয়ং শ্রীহরির নগরী।
অযোধ্যায় গিয়ে প্রথমেই সরযূ নদীর জলে স্নান করি। প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী নদী। স্নান করতে করতে আমি যেন ত্রেতাযুগে ফিরে গেলাম। মনে হল এই সেই নদী, যে নদীর জলে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্নান করেছেন। এমনকি তাঁর অবতার লীলাও সমাপন করেছেন। সরযূর নদী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের স্পর্শ অনুভব করতে গেল। হৃদয়টা শান্ত হয়ে গেল। বারবার মনে হতে লাগত রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অবতার লীলা সমাপনের বিবরণটি। এই সরযূ নদীতেই ভ্রাতাদের সঙ্গে সশরীরে অবতার লীলা সমাপন করেছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র।
অধ্যর্ধযোজনং গত্বা নদীং পশ্চান্মুখাশ্রিতাম্।
সরযূং পুণ্যসলিলাং দদর্শ রঘুনন্দনঃ।।
তাং নদীমাকুলাবর্তাং সর্বত্রানুসরন্ নৃপঃ।
আগতঃ সপ্রজো রামস্তং দেশং রঘুনন্দনঃ ॥
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, ১১০.১-২)
“অযোধ্যা থেকে দেড় যোজন দূরে গিয়ে রঘুকুলনন্দন ভগবান শ্রীরাম পশ্চিমাভিমুখ হয়ে নিকটস্থ পুণ্যসলিলা সরযূ নদী দর্শন করেন।
সরযূনদীর চারদিকে ভ্রমর উঠছিল। সেখানে সবদিকে ঘুরে ফিরে রঘুনন্দন রাজা শ্রীরাম প্রজাগণের সঙ্গে এক উত্তম স্থানে এলেন।”
স্নান সমাপন করে প্রথমেই গেলাম হনুমান গঢ়ি মন্দিরে। প্রথা অনুসারে হনুমান গঢ়ি মন্দিরে পূজা দিয়ে হনুমানজীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে হয়। হনুমানজীর আশীর্বাদ নিয়েই পরবর্তীতে শ্রীরাম জন্মভূমি মন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে হয়। মন্দিরটি অসংখ্য মন্দিরের মাঝখানে কিছুটা উচ্চতায় অবস্থিত। ৭৬টি ধাপ অতিক্রম করে তবেই হনুমানজীর মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। হনুমান গঢ়ি মন্দিরে পূজা দিয়ে এরপরে ধীরেধীরে আমি এবং আমার সাথে আরও দুইজন মিলে জন্মভূমি মন্দিরের অভিমুখে অগ্রসর হলাম।জন্মভূমি মন্দিরে যেতে পথটি চারফিট প্রশস্ত দেড়-দুই কিলোমিটারের একটা খাচায় মোড়ানো কারাগার, যা কিছুক্ষণ পরেপরেই তল্লাশি চেক হতে হতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। শ্রীরামজন্মভূমিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিমা একটা অস্থায়ী তাবুতে রাখা। চারিদিকে প্রচুর হনুমানসহ বানরসেনা। আমাকে অন্যান্য তীর্থযাত্রীরা বললো, বানর থেকে সাবধানে থাকতে। আমিও অন্যদের সাবধান করলাম, এরমধ্যেই দেখি আমার হাতের প্রসাদ উধাও। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম এক বানর প্রসাদের পাত্রটি নিয়ে গাছের ডালে বসে আনন্দে খাচ্ছে। প্রথমে একটু খারাপ লেগেছিল, পরক্ষণেই আমার মনে হল পূজাটা স্বার্থক হয়েছে; যাঁর কাছে এসেছি তিনিই তাঁর প্রিয় বানরসেনার মাধ্যমে প্রসাদটি গ্রহণ করলেন।অযোধ্যা নাম স্মরণেও মহাপুণ্য হয়।চারিদিকে হাজার হাজার মন্দির।শ্রীজন্মভূমিতে অস্থায়ী মন্দিরের কিছু দূরেই থরে থরে সাজানো আছে প্রস্তাবিত শ্রীরামজন্মভূমি মন্দিরের জন্যে রাজস্থান থেকে আনা অপূর্ব কারুকাজ খচিত পাথর এবং সারা পৃথিবী থেকে শ্রীরাম ভক্তদের আনা জয় শ্রীরাম লেখা ইট। অল্পকিছু আত্মঘাতী হিন্দুদের বাদ দিয়ে শ্রীরামজন্মভূমিতে একটি ভব্য মন্দির শতকোটি হিন্দুর প্রাণের দাবি। ভারতবর্ষের বামপন্থী বা তাদের সহযোগী কয়েকটি মিডিয়া হাউজের নিউজ দেখে কখনই বোঝা যাবে না, এ মন্দিরকে ঘিরে মানুষের আবেগের কথা। এক মাঝবয়সী মহিলাকে দেখলাম তিনি প্রস্তাবিত মন্দিরের জন্যে আনা পাথরগুলোর উপরে বারবার হাত বুলাচ্ছেন এবং জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন।একদিন কারুকার্য খচিত এ পাথরগুলো দিয়েই মন্দির হবে, এ স্বপ্ন তার চোখেমুখে। পাথরগুলোর প্রতি তার মাতৃত্বের বাৎসল্য প্রেম দেখে আমারও চোখের জল চলে আসলো। মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো, পৃথিবীর অন্য কোন জাতি কি আছে যারা বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে পৈশাচিকভাবে নির্যাতিত হয়েও পরাধীনতার ক্ষতচিহ্ন সাজিয়েগুছিয়ে রেখেছে? এটা সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও নেই। পৃথিবীর সকল জাতিই তাদের পরাধীনকালীন সময়ে বিদেশীদের সকল চিহ্ন মুছে দিয়েছে।শুধু ব্যতিক্রম ভারতবর্ষ।