দীক্ষা নিয়ে পেলাম কি?


কি পেলাম ঠাকুরের দীক্ষা নিয়ে??

স্বাদের প্রিয় আমিষ মেনু ছাড়লাম, মদ মাংসের পার্টি ছাড়লাম, সিগারেটের সুখটান ছাড়লাম, সৎসঙ্গে যাওয়ার জন্য সন্ধায় ক্লাবে-গলিতে বন্ধুদের সাথে মজার আড্ডা ছাড়লাম, টাকা কামানোর পাগলপাড়া নেশা থেকে কখন যেন দূরে চলে গেলাম, অবসরের আরাম-আয়েস ছাড়লাম, নানা বিধি-নিষেধে নিজেকে জড়ালাম….কত কি!!

কত কত লোকই তো কোন ঠাকুরের দীক্ষা নেয়নি! বা, এমন গুরুর দীক্ষা নিয়েছে যেখানে কিছু করতে হয় না, শুধু দীক্ষা নিয়েই নাকি শরীর-মন পবিত্র – হয়ে যায়? তারা তো অনেকেই আমার চেয়ে কত্ত ভাল আছে। শিক্ষায়-পদমর্যাদায়-বিত্ত- বৈভবে, সামাজিক প্রতিষ্ঠায় আমার চেয়ে অনেক অনেক ভাল আছে তারা। তবে আমার কি প্রয়োজন এই দীক্ষা, ইষ্টভৃতি, সৎসঙ্গে যোগদান, নিয়মিত প্রার্থনা, দেওঘর গিয়ে আচার্য্য দর্শন, ইষ্ট নির্দেশ পালন? কি লাভ তাতে?

সেই লাভ, সেই পার্থক্য সেই বুঝেছে যে পেয়েছে। সেই অমূল্য রতন যে,কোন কিছুর মূল্যে মূল্যায়িত করা অসম্ভব।

পেয়েছি জীবনের আয়না। আমি বাইরের জগতের সবকিছু দেখতে পারলেও নিজের চেহারাটাই যে নিজের চোখে দেখতে পারিনা,- যদি সামনে আয়না না থাকে। তেমনি আমার নিজের স্বভাবের খাঁকতি, জীবনের ত্রুটিগুলি আমি কিভাবে ধরবো? যদি আমার সামনে জীবনের আয়না, তথা জীবন্ত আদর্শ, না থাকে? শ্রীশ্রী ঠাকুরের কথা ও জীবন সম্পর্কে জেনে -অনুভব করে, তাঁরই জীবন্ত প্রতিরূপ শ্রীশ্রী আচার্য্যদেবকে দেখে, তাঁর সংস্পর্শে এসে, তাঁর ভালবাসার স্পর্শ পেয়ে আমি যে নিজেকে চেনার উপায় পেয়েছি। চেষ্টা করি প্রতিনিয়তঃ নিজেকে শুধরে, নিজের চরিত্রের কাল ময়লাগুলি চিহ্নিত করে সেগুলি মুছে ফেলতে। যদিও আমার অলসতা, দূর্বলতা,জড়তা আমাকে বারে বারে পেছনে টেনে রাখে। ঠাকুরকে না ধরলে যে আমি নিজেকে চেনার রাস্তাই পেতাম না। স্বভাবের, চরিত্রের সব আবর্জনাগুলিকেই ভুল করে সম্পদ ভেবে সযত্নে আকঁড়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করতাম। বুঝতেই পারতামনা ভাল কি, আর মন্দই বা কি!!

পেয়েছি জীবনের পরম নির্ভরতা। পেয়েছি নিশ্চিত আশ্রয়। যখন বয়সে ছোট ছিলাম তখন নির্ভর ছিলাম আমার বাবা-মায়ের উপর। ছিল নিশ্চিত জীবন। ছিলনা কোন উদ্বেগ, ভয়, দুর্ভাবনা। মাথার উপর যে বাবা আছেন। তিনিই তো সব সামলে নিতেন আমার জীবনের ছোট-বড় সব সমস্যা। যখন বড় হয়েছি, সংসারের দায়ীত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছি তখন বাবা-মাও যে আমার উপর নির্ভর হলেন। বেড়েছে উদ্বেগ, ভাবনা, দায়ীত্ব। সংসার সমুদ্রে ভাল-মন্দ বিচার করতে করতে, ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। সংসারে যখনই কোন সমস্যায় পড়ে চোখে অন্ধকার দেখার অবস্থা,চতুর্দিকে সব দরজা বন্ধ,- তখনই প্রত্যক্ষ অনুভব করেছি শ্রীশ্রী ঠাকুরের দয়া। আচার্য্যদেবের কাছে গিয়ে পেয়েছি নিশ্চিত সমাধান। বুঝতে পেরেছি, আমি অভিভাবকহীন নই। আমার জীবনের মালিক যে আমায় প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছেন, অন্ধকারে পথ দেখিয়ে চলেছেন। আমার কোন উদ্বেগ নেই, দুঃচিন্তা নেই, আশংকা নেই। তিনি যে বলেই দিয়েছেন,” যাই কেন কর না, ভয় নেই- মরবে না। কিন্তু কষ্টের জন্য রাজী থেকো।”

খুঁজে পেয়েছি বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। মানুষ শুধু নিজের জন্য বেঁচে আনন্দ পায় না। কাউকে খুশী করে, তৃপ্ত করেই সে খুঁজে বাঁচার সার্থকতা, তাতেই তার মনের আনন্দ। তাই কেউ ব্যস্ত মা’কে খুশী করতে, কেউ বা বউকে, প্রেমীকাকে, বন্ধুকে। কিন্তু যদি এমন কেউ থাকে জীবনে,- যাকে খুশী করলেই সকলকে খুশী করা যায়, যাকে মাথায় ধরলে সকলের মঙ্গল হয়, -তবেই জীবনের সার্থকতা। তিনি যদি হন বৃত্তি- প্রবৃত্তির উর্ধ্বে তবেই তাঁর তৃপ্তির জন্য আমার করাগুলি জীবনকে নিয়ে যায় উর্ধমুখী চলনে। আমি শ্রীশ্রী ঠাকুরের দীক্ষা নিয়ে পেয়েছি জীবনের সেই গন্তব্য। তাঁরই জীবন্ত প্রতিরূপ শ্রীশ্রী আচার্য্যদেবকে খুশী করাই আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, আমার একমাত্র মঙ্গল ও সার্থকতা – তা আমি বোধ করতে পেরেছি মর্মে মর্মে।

পেয়েছি নিরন্তর আনন্দের সন্ধান। শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে যে আমার জীবন-সংসার সমস্যাবিহীন হয়ে গেছে, -তা নয়। আমি যে ভুল করে কর্মফলের যাঁতাকলে পড়ি না- তা নয়। বরং ঠাকুর যেন আমায় একটু বেশীই সমস্যায় রাখতে পছন্দ করেন,- যাতে আমি আরো যোগ্য হয়ে উঠি, ধৈর্যশীল ও কষ্টসহিষ্ণু হতে পারি। বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তা সমাধান করার রাস্তা শিখতে পারি। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর যেমন বললেন, ” লোহা পুড়িয়ে দাঁ বানানোর কথা।” ঠাকুর ও তেমনি আমাদের আগুনে পুড়িয়ে দাঁ বানাতে চান। কিন্তু এর মধ্যে ও সকালবেলা ইষ্টভৃতি করে যখন প্রতিদিন সাংসারিক কাজে ডুব দেই,- প্রতিক্ষন, প্রতি মুহুর্তে মনে বিরাজ করে এক পরম পবিত্র আনন্দ, এক সন্তুষ্টি,- অনুভব করি এক পবিত্র শক্তির সঞ্চারনা । সন্ধ্যা সময় সৎসঙ্গে গিয়ে যেদিন কীর্তনে যোগ দেই সারাদিনের অবসাদ, ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা কোথায় পালিয়ে যায়,- টেরই পাইনা। আবার নতুন করে ঠাকুরকে ধরার প্রেরনা পাই। যতক্ষন আমার মননে-চিন্তায় তিনি,- ততক্ষন শুধুই আনন্দ, আর আনন্দ। বাইরের সমস্যা আমার ভিতরের সেই আনন্দকে স্পর্শ করতে পারেনা একটু ও।

পেয়েছি আমার বৃত্তির অধীন ইচ্ছাগুলির লাগাম। ঠাকুরের দীক্ষা নিয়ে আমি যে একদম সাধু পুরুষ হয়ে গেছি তা নয়। বৃত্তি-প্রবৃত্তির নাচন আমার মনের ভিতরও চলে প্রতিনিয়ত৷ নিষিদ্ধ লোভের প্রতি আকর্ষন আমার ও রয়েছে। কিন্তু বৃত্তিগুলি যখন আমাকে টেনে নীচে নামাতে চায় সেই সময় আমার চেতনায় এসে উদয় হয় আমার ইষ্টদেবতা ও শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের মুখখানি। ভয় হয়,- তিনি যে আঘাত পাবেন। কিভাবে দাড়াব তাঁর সামনে গিয়ে?তিনি যে মুখভার করে রাখবেন। বৃত্তিগুলিকে তখন আমার শত্রু মনে হয়। তার বাঁধন থেকে জোর করে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করি। তিনিই তখন দয়া করে বের করে আনেন সেই বন্ধন থেকে।

পেয়েছি আমার জীবনের শিক্ষক। যিনি হাতেকলমে শিখিয়ে দেন জীবনের পথচলার মরকোচগুলি। আমি স্কুলে-কলেজে পড়েছি, উচ্চ ডিগ্রী নিয়েছি। সেখানে আমার শিক্ষকরা অনেককিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু কিভাবে জীবনের প্যাচানো পথে চলবো, কিভাবে মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করবো, তাদের সেবা করবো, কিভাবে বিয়ে করবো, স্ত্রীর সাথেই বা কিভাবে চললে সংসারে শান্তি বজায় থাকবে, কিভাবে ব্যবহার করলে সন্তান মানুষ হবে, কিভাবে সার্বিক সুস্থ থাকা যায়.. ইত্যাদি সংসারজীবনের ঘোরপ্যাচগুলি যে কেউ শেখায়নি। আমায় শিক্ষিত বানিয়েছে,- কিন্তু মানুষ হওয়ার পাঠ যে কেউ দেননি।

শ্রীশ্রী ঠাকুর জীবনের এমন কোন দিক বাদ নেই যার সম্পর্কে দিক নির্দেশ করে যাননি। তার সেই বলাগুলির জীবন্তরূপ দেখি আচার্য্যদেবের মধ্যে। দেখে-শুনে-জেনে-অনুভব করে একটু একটু শিখতে চেষ্টা করি। আমি এখনো পুরোপুরি মানুষ হইনি,- কিন্তু চেষ্টা করি হতে। যতটুকু শিখি, ততটুকুই হই,- ততটুকুই শান্তিতে থাকি। আমি ছাত্র দূর্বল, কিন্তু আমার জীবনের শিক্ষক তাই বলে আমার উপর হাল ছেড়ে দেননা। হোঁচট খেলে আবার উঠিয়ে চলতে শেখান। তিনি বলেন, ” কৃপা মানে করে পাওয়া”। ” আশীর্বাদ মানে অনুশাসনবাদ”। এখানে বুজরুকি, অলৌকিকতার কোন স্থান নেই। তিনি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, ” কর, হও, পাও। “

পেয়েছি কত কত গুরুভাই, মা ও তাদের অফুরান ভালবাসা। নিজের রক্তের সম্পর্কের চেয়েও গুরুভাইদের সম্পর্ক যেন অনেক বেশী গভীর। যেখানেই গেছি সেখানেই পেয়েছি আমার নিজের গুরুভাই। কোথাও কখনো একা মনে হয়নি নিজেকে। এই যান্ত্রিকতাপূর্ন ও তীব্র প্রতিযোগিতাময় সংসারে সৎসঙ্গী গুরুভাইদের মধ্যে এই মধুর, স্বার্থহীন সম্পর্ক এক অমূল্য পাওনা। আমাদের সকলের ‘ পিতা’ যে একজন। তাঁকে খুশী করাই যে আমাদের সকলের উদ্দেশ্য। তাই আমাদের স্বার্থ এক, উদ্দেশ্য এক। যেদিন সারা পৃথিবী ঠাকুরময় হবে সেদিন ভৌগলিক সীমানার ঘেরাটোপ দরকার আর পড়বে না। ” যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” বলে চিৎকার করতে হবে না।

আমি জানি ও বিশ্বাস করি,- উঁচু গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করতে করতে ছোট হরিন যেমন কালের প্রবাহে জিরাফে পরিনত হয়েছে,- ঠিক তেমনি, আমার ঠাকুর, আমার জীবন্ত আদর্শকে লক্ষ করে প্রতিনিয়ত তাঁর মনের মত হওয়ার জন্য আমার এই চেষ্টা একদিন আমাকে জিরাফের মতই উন্নত, উচ্চ, পবিত্র মানুষে পরিনত করবে। আমার বংশ-পরম্পরায় প্রবাহিত হবে এই চেষ্টার ফল।


ডাঃ রাজেশ চৌধুরী .