মোবাইল ‘পার্কিং’ আর মোবাইল ‘ফার্স্টিং’ এক পারিবারিক রক্ষাকবচ

অমিতাভ নাথ

সারাদিনের কর্মজর্জর লেনদেন শেষ করে ঘরে ফিরতেই শূন্যতাবোধ আমাকে ঘিরে ধরে। মনে হয় বড়ো একা। আমি ছাড়া ঘরে আরও একজন এই একাকীত্ব-এর স্বাদ নেয়। ঘরের বেড়ালছানাটি। পরিবারের বাকি তিনটে মানুষই তখন মগ্ন। বসে বা শুয়ে ‘মোবাইল’ ধ্যান-এ। এই মোচাইলধ্যান বা মোবাইল সঙ্গ ভঙ্গ করলেই তারা বিরক্ত হয়। তর্কযুদ্ধের পটভূমিকায় জর্জরিত হয় পারিবারিক শান্তি ও সম্পর্ক।
*এমন চিত্র এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে। এটিই সমাজের প্রতিটি বর্গ, প্রতিটি পেশার মানুষের এক চলমান ‘পরিবার চিত্র’।
এনিয়ে ভাবলেই মানসিকভাবে জর্জরিত, ক্লান্ত ‘আমি’ দিশেহারা হই। শুধু পথ খুঁজি। এক নির্বাক আলস্য যেন আমাদের গ্রাস করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধুই অবক্ষয়কে দেখে পওয়া ছাড়া যেন গত্যন্তর নেই।

বলছি কর্মব্যস্ততা, তাই একে অপরকে সময় দিতে পারছি না। আবার ব্যস্ততার ফাঁকে অবকাশেও সামাজিক মাধ্যমে ডুবে যাচ্ছি। নিজেকে নিজেই বিচ্ছিন্ন করছি। এক অদ্ভুত পরস্পর বিরোধীতা-ব্যস্ততার বিপরীতে বিচ্ছিন্নতা। এই দুয়ের মধ্যিখানে বিপর্যস্ত আমাদের পারিবারিক বন্ধনা।

ঘরে ফিরেই এই বিচ্ছিন্নতায় নিজেকে সেদিন ডুবিয়ে দিতে গিয়েই জ্যান্ত বিচ্ছিন্নতার এক ঘটনার সাক্ষী হলাম। সমাজ মাধ্যমে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। একটি শিশু কেঁদে কেঁদে হাত জোড় করে ঠাকুরকে বলছে, তিনি যেন তার মায়ের ফেসবুক বন্ধ করে দেন। এই ফেসবুকের জন্যই আবদার করেও সে মাতৃসঙ্গ হারা। মা অফিস সেরে ঘরে এলেও অতিব্যস্ত থাকেন ফেসবুকে। ব্যস্ততা আর অবকাশের মাঝেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মাতৃকৃত এই কর্মের মধ্যিখানে একাকীত্বে জর্জরিত শিশুটির প্রার্থনা মা-র ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হোক। এই “অফিসিয়াল” মায়ের বিপরীতে ঘরে থাকা মায়েরাও (হাউজ ওয়াইফ বলবো না) গৃহকাজের ব্যস্ততার অবকাশেও এখন সন্তানসঙ্গ বিচ্ছিন্ন। বাবারা তো আছেনই। প্রায় পরিবারে এখন দাদু-ঠাকুমাও থাকেন না। অণু পরিবারে এই কর্মব্যস্ততা আর অবকাশেও বিচ্ছিন্নতার যাঁতাকলে অণু পরিবার ভেঙে “এক ব্যক্তি-এক পরিবার” প্যাটার্ন এসে যাচ্ছে প্রায়।

এই যে প্যাশন, আমি ও আমাদের দাঁড় করিয়েছে ভাঙনের প্রান্ত:সীমায়। এই একাকীত্ব ও এর থেকে আসা বিরক্তিবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতার বুঝেই বা না বুঝেই অতিরিক্ত এই স্বাদ নিতে চাওয়া – এসব নিয়ে কোথায় চলেছি? ক্ষয়ে গেছে পরিবারবোধ ও আত্মীয়তার স্বাদ। যে পরিবার যৌথ থেকে অণু হয়ে ‘এক ব্যক্তি – এক পরিবার’ হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন এক একটি দ্বীপ। এইসব বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বহমান সমাজ ব্যবস্থায় অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। মানুষ-এর এই বিচ্ছিন্ন পরিণতিই কী সভ্যতার শেষ যুগ?

দিশেহারা আমরা আশ্রয় খুঁজছি। কোথায় সোনালীরেখায় সেই গন্তব্য। আশ্রয়ের, গন্তব্যের জন্য এখন বাঁকফেরার প্রয়োজন। নদী যেমন বাঁক ফেরে গতিপথ সঠিকভাবে সচল ও যুগোপযোগী অথচ তার সাংস্কৃতিক বহমানতা বজায় রাখে তেমনি আমাদের প্রয়োজন বাঁক ফেরা। প্রযুক্তির ব্যবহারিক এই বিষাক্ততায় ক্রমাগত পিছিয়ে আমরা আদিম মানব সভ্যতার গণ্ডীও কী পেরিয়ে যাব? সন্তানের থেকে মাতৃস্নেহ কেড়ে নেওয়া এই ‘আমাদেরই গড়া’ পৃথিবীতে এখন মানবীয় অন্ধকার। যা আমাদের প্রজন্মের লজ্জা।

শুধু সামান্য , অথচ দৃঢ় ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপই প্রযুক্তির এই অতি-ব্যবহার আটকাতে সক্ষম। যার জন্য অর্থব্যয়, আইন প্রয়োগের প্রয়োজনই নেই। শুধু বিন্দুসদৃশ আন্তরিক ইচ্ছা আর ব্যবহারিক ক্ষুদ্র পরিবর্তনই এই বিভীষিকাময় অবস্থা পাল্টাতে পারে।

তাই, কর্মমুখর, সংগঠিত, আনন্দময়, সংস্কারিত ও আত্মীয়তার আবর্তে থাকা পরিবারই পারে ঠাকুরের কাছে বিচার চাওয়া শিশুটির মাতৃসঙ্গ ফিরিয়ে দিতে। কর্মচঞ্চল দিনের শেষে ছুটির অবসরে সন্তানের বায়না মেটাতে, গিন্নী বা কর্তার সাথে খুনসুটিতে মোবাইলকে কিছুটা সময় ‘পার্কিং’- (নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার না করা) বা ছুটির দুপুরে নিভৃত আলস্যে প্রিয় পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে ক’ঘন্টা ‘মোবাইল ফার্স্টিং’- (কোনও ভাবে ব্যবহার না করা) হতে পারে সামান্য অথচ দৃঢ় ইতিবাচক এক পদক্ষেপ।